দেশীয় হোমিওপ্যাথি মাদার টিংচার কোন কোম্পানির ঔষধ ভালঃ


এর উত্তরে অনেকে অনেক ধরনের মন্তব্য করেছেন।
আমিও আমার জ্ঞান, অভিজ্ঞতা শেয়ার করে আমার মন্তব্য করেছি।
এখন আরেকটু বেশি করে,আরেকটু ব্যাখ্যা করে বলার চেষ্টা করছি।
আগে আমাদের জানতে হবে মাদার টিঙ্কচার কি ?
হোমিওপ্যাথি ঔষধ তৈরির অনেক গুলো উৎস আছে,তার মধ্যে প্রায় ৯৫% ঔষধ তৈরি হয় বিভিন্ন ধরনের হার্বস্ হতে তৈরি।
হার্বস্ বা বিভিন্ন ধরনের গাছ গাছালি হতে হোমিওপ্যাথি ফার্মাকোপিয়ার নিয়ম অনুযায়ী তৈরি প্রথম ঔষধ কে হোমিওপ্যাথির ভাষায় মাদার টিঙ্কচার বলে,যা সাধারণত ইংরেজি Q শব্দ দিয়ে বুঝানো হয়ে থাকে।
এরপর অনেকের প্রশ্ন থাকে মাদার টিঙ্কচার হোমিওপ্যাথি ঔষধ কি না ?
হাঁ অবশ্যই মাদার টিঙ্কচার হোমিওপ্যাথি ঔষধ,মা ছাড়া যেমন সন্তান হয় না, তেমনি মাদার টিঙ্কচার ছাড়া পোটেন্সি ঔষধ ও তৈরি হয় না, অবশ্য যে সকল ঔষধ হার্বস্ হতে তৈরি সেগুলো।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে মহাত্মা হ্যানিমান অর্গাননে মাদার টিঙ্কচার ব্যাবহার নিষিদ্ধ করেছেন, তাহলে এখনো কেন এর উৎপাদন এবং ব্যাবহার হচ্ছে ?
এর উত্তর আমি আগেও কয়েকবার দিয়েছি, এখনও পুনরায় দিচ্ছি।
মহাত্মা হ্যানিমান এর সময় হোমিওপ্যাথি ঔষধের সর্বোচ্চ পরিমাণ ছিল প্রায় একশত ত্রিশটি,তার সবগুলোই ছিল উচ্চ শক্তিতে কার্যকর।
যেমন লাইকোপোডিয়াম হার্বস্ হতে তৈরি হওয়া সত্ত্বেও এর মাদার বা নিম্ম শক্তি কোন কাজ করে না।
মনে রাখবেন লাইকোপোডিয়াম সেন্টিসিমাল পদ্ধতিতে ১২ শক্তির নিচে কোন কাজ করে না।
কিন্তু পরে কালের পরিক্রমায় হোমিওপ্যাথিতে নতুন নতুন অনেক ঔষধ যুক্ত হয়েছে,যার একটি ক্ষুদ্র অংশ অতীব কার্যকরী, কিন্তু মাদার টিঙ্কচার বা নিম্ম শক্তিতে ফলপ্রসূ,উচ্চ শক্তিতে নয়।
যেমন ইচিনেসিয়া,ক্যালোট্রপিস,আলফালফা,এভেনা,কালোমেঘ,স্ক্রফুলেরিয়া মেরিল্যান্ডিকা,ক্যালেন্ডুলা,ব্যালসামাম পেরু,ওয়াইদানিয়া সম্মিফেরা,ভাইবারনাম ওপু,ভাইবারনাম প্রুনি,ট্রিলিয়াম পেন্ডু,রাওলফিয়া,জিরেনিয়াম ম্যাক,এলেট্রিস ফেরিনোসা,গ্যালিয়াম এ্যপেরাইন,আর্টিকা ইউরেনস্,প্যাসিফ্লোরা ইত্যাদি।
কেউ স্বীকার করুক বা না করুক,এর মধ্যে অনেক মাদার টিঙ্কচার কিন্তু লাইফ সেভিং ড্রাগস্ ও বটে, যেমন প্যাসিফ্লোরা,রাওলফিয়া,জিরেনিয়াম,ট্রিলিয়াম পেন্ডুলাম ইত্যাদি,এ ছাড়াও বিষাক্ত সাপের কামড়ে সিড্রন মাদার টিঙ্কচার ব্যাবহার করতে হবে, এখানে পোটেন্সি কাজ করবে না,অনেক গুলো আবার ভালো উপশম দায়ক ও বটে।
বিশেষ করে আরোগ্য অসাধ্য রোগী গনকে উপশম দিতে কখনো কখনো মাদার টিঙ্কচার ছাড়া অন্য কোন উপায় থাকে না, বিশেষ করে যেখানে জীবনী শক্তি জরাজীর্ণ, যেখানে পোটেন্সি ঔষধের চাপ রোগীর শরীর নিতে পারবে না।
একটি কথা আমাদের মনে রাখা উচিত যে, রোগীর প্রয়োজনে এবং অন্তিম মুহূর্তে সকল প্রকার চিকিৎসা বৈধ।
তবে একথা অনস্বীকার্য যে,যারা কথায় কথায়,যখন তখন,একান্ত প্রয়োজন ছাড়াই, হোমিওপ্যাথির জ্ঞানের স্বল্পতার কারনে,মায়াজমের জ্ঞান না থাকায়,অল্প সময়ে অধিক সংখ্যক রোগী দেখার প্রত্যাশায়, অধিকতর লাভের আশায় মাদার টিঙ্কচার ব্যাবহার করেন,তারা হোমিওপ্যাথির শত্রু।
এ ধরনের চিকিৎসক গনের উচিত সঠিক হোমিওপ্যাথির শিক্ষা গ্ৰহন করা,আর না হয় হোমিওপ্যাথি কে কলংক যুক্ত না করে, হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক পেশা ছেড়ে দিয়ে অন্য কোন সহজলভ্য পেশা গ্ৰহন করা।
এরপর আসে দেশীয় কোন কোম্পানির মাদার টিঙ্কচার ভালো ?
এক কথায় এর উত্তর দেয়া বেশ কঠিন।
কোনো কোম্পানির মাদার টিঙ্কচার ই সবগুলো ভালো নয়, আবার সবগুলো খারাপ ও নয়।
প্রত্যেক কোম্পানির মাদার টিঙ্কচার এর মধ্যে সবগুলো এক মানের হয় না।
বর্তমানে বাংলাদেশের কোন কোম্পানির মাদার টিঙ্কচার ই,নব্বই দশকের পুর্বের মতো মানসম্পন্ন নয়,প্রত্যেক কোম্পানির ঔষধের মান আগের তুলনায় অনেক নিম্মমুখি ।
যেমন জার্মানির উইলমার শোয়েব কোম্পানির তৈরি ক্যালেনডুলা মাদার অপেক্ষা পাকিস্তানের মাসুদের তৈরি ক্যালেনডুলা মাদার কমপক্ষে দ্বিগুণ কার্যকরী।
প্রত্যেক কোম্পানির কিছু মাদার টিঙ্কচার অন্য কোম্পানি হতে ভালো হয়, আবার কিছু মানের দিক দিয়ে খারাপ ও হয়।
এখানে চিকিৎসককে, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে, রোগীর উপর পর্যবেক্ষণ করে, উপকারিতা বুঝে সিদ্ধান্ত নিতে হয়,বা অভিজ্ঞ জনের পরামর্শ নিতে হয়।
আমি ১৯৮২ সাল হতে ঢাকার নিউ লাইফের মাদার টিঙ্কচার ব্যাবহার করে আসছি।
তখন বাংলাদেশে অল্প কয়েকটি দেশীয় হোমিওপ্যাথি ঔষধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান মাদার টিঙ্কচার ও বায়োকেমিক ঔষধ তৈরি করতো।
আর বিদেশি হোমিওপ্যাথি ঔষধ বলতে একমাত্র আমেরিকার B&T কোম্পানির ঔষধ ছিলো।
আমি ১৯৮২ সালের আগে শুধু মাত্র B&T কোম্পানির মাদার ও বায়োকেমিক ব্যাবহার করতাম।
যখন ১৯৮২ সালে প্রথম যখন ঢাকার নিউলাইফ কোম্পানির মাদার টিঙ্কচার ব্যাবহার শুরু করি, তখন আমার মনে হয়েছে কার্যকারিতার দিক দিয়ে B&T কোম্পানির মাদার টিঙ্কচার ১০০ নাম্বার পেলে,নিউলাইফের মাদার টিঙ্কচার পাবে ৭০ নাম্বার,অথচ নিউ লাইফের মাদার টিঙ্কচার এর মুল্য ছিলো B&T এর তুলনায় প্রায় পাঁচ ভাগের এক ভাগ।
এরপর আমি ১৯৮৩ সালে একদিন নিউ লাইফের ম্যানেজার সাহেব কে জিজ্ঞেস করলাম আপনাদের চেয়ে ভালো মানের ঔষধ বাংলাদেশে আর কেউ তৈরি করে কি না ?
উনি বললেন হেলাল এন্ড কোম্পানি আমাদের চেয়েও উন্নত মানের ঔষধ তৈরি করে।
আমি যথেষ্ট অবাক হয়ে গেলাম, কারন এভাবে কেউ কথা বলে না,অন্যের শ্রেষ্টত্ব স্বীকার করে না।
আমি খোঁজ করে হেলাল এন্ড কোম্পানির অফিসে গেলাম।
কিন্তু তাদের অফিস দেখে আমার মোটেও পছন্দ হয় নি,ছোট একটি দোকান,তার উপর সেলস্ ম্যান একজন, ঔষধের পরিমাণ ও অনেক কম।
তারপরও আমি কিছু মাদার টিঙ্কচার ক্রয় করলাম,দাম নিউলাইফের তুলনায় কিছুটা বেশি ছিলো।
আমি ব্যাবহার করে বুঝলাম উনাদের ঔষধের মান নিউলাইফ হতে ভালো।
যদি B&T এর মাদার টিঙ্কচার কে ১০০ নাম্বার দেয়া যায়, তবে হেলাল এন্ড কোম্পানির মাদার টিঙ্কচার কে ৮০ নাম্বার দেয়া যাবে।
আগে প্রত্যেক কোম্পানির নিজস্ব আলাদা মুল্য তালিকা ছিলো,কোম্পানি ভেদে ঔষধের মুল্যের বেশ প্রার্থক্য ছিলো।
গ্ৰাহক নিজের পছন্দানুযায়ী যে কোন কোম্পানির মাদার টিঙ্কচার কিনতে পারতেন, এখনো পারেন।
কিন্তু পরবর্তীতে সকল দেশীয় হোমিওপ্যাথি ঔষধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান সমূহ একত্র হয় একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে,
যার মুল কথা ছিল ঔষধের মুল্য সবাই সমান রাখবেন।
এটা করতে গিয়ে ঔষধের মান আর ঠিক থাকলো না।
সবাই চেষ্টা করতে লাগলেন চিকিৎসক গনকে কত্তো বেশি কমিশন দেয়া যায়।
আর আমরা নীতি নৈতিকতা হীন, নীচু মানের ও মনের হোমিওপ্যাথ নামের চিকিৎসক গন সেটা লুফে নিলাম।
আমরা আর মান নিয়ে বিশেষ কোনো চিন্তা ভাবনা করলাম না।
যদি ঔষধে রোগীর উপকার না হয়, তাহলে কমিশন পেয়ে কি লাভ হবে ?
হেলাল এন্ড কোম্পানি এখন মনে হয় আর ঔষধ তৈরি করে না।
কয়েক বৎসর পুর্বে কিছু ঔষধ তৈরি করেছিলো, কিন্তু মান আগের মতো ছিল না।
বর্তমানে বাংলাদেশের কোন কোম্পানির মাদার টিঙ্কচার এর উপর আমার খুব একটা আস্থা নেই, কমবেশি সবাই প্রায় একই রকম।
আমার মনে হচ্ছে যে,যখন হতে দেশীয় ঔষধ কোম্পানী সমুহ চুক্তি স্বাক্ষর করেছে,সে হতে দেশীয় ঔষধের মান নিম্ম মুখিতা শুরু হয়েছে।
তবে তুলনামূলকভাবে কিছুটা হলেও আস্থা আছে নিউলাইফ কোম্পানির মাদার টিঙ্কচার এর উপর।
এক সময় বাংলাদেশে বিদেশী হোমিওপ্যাথি ঔষধ বলতে B&T কে ই বুঝতো মানুষ।
এরপর ১৯৮৫ সালে শুরু এবং ১৯৮৬ সাল হতে জার্মানির উইলমার শোয়েব কোম্পানির ঔষধ বাংলাদেশে প্রচুর আসতে শুরু হলো।
এক পর্যায়ে বিটি ঔষধের ব্যাবহার বাংলাদেশে প্রায় বন্দ হয়ে গেলো, শেষে উইলমার শোয়েব বিটি কোম্পানি কিনে নিয়ে পরে কারখানা বন্ধ ঘোষণা করে।
যার দ্ধারা একটি ঐতিহাসিক এবং বিশ্ব বিখ্যাত কোম্পানির পতন ঘটে গেলো।
বর্তমানে বিদেশি হোমিওপ্যাথি ঔষধ প্রস্তুতকারী কোম্পানি সমুহের মধ্যে মানের দিক দিয়ে উইলমার শোয়েব প্রথম স্থানে কোন সন্দেহ নেই।
আমার অভিজ্ঞতার আলোকে বলছি,আমার মতে দ্বিতীয় স্থানে আছে পাকিস্তানের মাসুদ।
বেশিরভাগ ঔষধ উইলমার শোয়েব এর ভালো,তবে মাসুদ পাকিস্তানের প্রায় সকল ঔষধ উইলমার শোয়েবের পরে বা দ্বিতীয় স্থানে হলেও কিছু মাদার টিঙ্কচার উইলমার শোয়েবের চেয়েও মানে অনেক উন্নত।
এর একটি হলো ক্যালেনডুলা, আপনারা পরীক্ষা করে দেখতে পারেন।
আর আমি ব্যাবহার করে দেখেছি ফ্রান্সের তৈরি মাদার টিঙ্কচার অপেক্ষা সুইজারল্যান্ডের তৈরি মাদার টিঙ্কচার তুলনামূলক ভাবে মানে উন্নত।
যদি দেশীয় হোমিওপ্যাথি ঔষধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান সমূহ ঔষধের মান উন্নয়নে সচেষ্ট হয়, তবে আমার বিশ্বাস অবশ্যই চিকিৎসক গন নির্ধিদ্ধায় দেশীয় হোমিওপ্যাথি ঔষধ ব্যাবহার করবেন। -ডাঃ মহিব্বুর রহমান।

 

Comments

Popular posts from this blog

জেলসিমিয়াম (GELSIMIUM – 30) এর জাদুকরী শক্তি । অজ্ঞাত উৎসের জ্বর (Pyrexi...

ঘাড় ব্যথার হোমিও চিকিৎসা | Neck Pain Homeopathic Treatment Bangla